আদর্শ বনাম মতাদর্শ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি, জন আকাঙ্ক্ষার আদর্শ কি?
আমাদেরকে অনেকে প্রশ্ন করেছেন 'আপনারা বলেছেন কোন তত্ব বা মতবাদ ভিত্তিক রাজনীতি করবেননা। তাহলে আপনারা কার আদর্শের রাজনীতি করতে চান'? এটা খুবই জরুরী একটা প্রশ্ন। কিন্তু এখানে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছে এবং এর দায়টা আমরাই নিচ্ছি। কেননা আদর্শ ও মতাদর্শের মধ্যকার পার্থক্যটা হয়ত আমরা বুঝাতে পারিনি।
আমাদের সমাজে 'আদর্শ বাবা', 'আদর্শ মা', 'আদর্শ শিক্ষক' এই শব্দগুলো বেশ প্রচলিত। এখানে 'আদর্শ' মানে কোন মতবাদ নয়। এখানে আদর্শ মানে ভাল মানুষ, নীতিনিষ্ঠ মানুষ। আমরা রাজনীতিতে নীতির কথা বলছি। নীতিগত প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যের আহবান জানাচ্ছি। একই সময়ে বলছি আমরা কোন মতাদর্শ বাস্তবায়নের জন্য রাজনীতি করব না, যেটা প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো করছে। কেন এটা বলছি আমরা?
আমরা বলেছি, বাংলাদেশে অনৈক্য ও বিভেদের মূলে তত্ত্ব ও মতাদর্শের রাজনীতি। আমাদের এই কথাকে অনেকে ভুল বুঝেছেন। আমরা বলেছি আমরা যে রাজনীতি করতে চাই সেখানে কোন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করব না। কোন মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করব না। অনেকে বলেছেন, যদি আদর্শ না থাকে তাহলে কি প্রতিষ্ঠা করবেন? আমরা তো আদর্শ প্রতিষ্ঠা করব না বলিনি। আদর্শ ও মতাদর্শের মধ্যে পার্থক্য আছে। যেমন আদর্শ হচ্ছে সাম্য, আদর্শ হচ্ছে ইসলাম। কিন্তু মতাদর্শ কি? মতাদর্শ হচ্ছে ওয়াহাবিজম, সালাফিজম, সমাজতন্ত্র। ওমুকের সমাজতন্ত্র, তোমুকের সমাজতন্ত্র, ওমুকের সমাজবাদ এগুলো হচ্ছে মতাদর্শ। এগুলো হচ্ছে মতবাদ। এই মতবাদ যখন আসে তখন একে অপরের মধ্যে হিংসা ছড়িয়ে দেয়। চট্টগ্রামে ওয়াহাবি বনাম সুন্নির মারামারি আমরা দেখেছি। আমরা বলেছি এই মতবাদ বা তত্ত্ব নয়। তাহলে ঐক্যবদ্ধ হওয়া যাবে কিভাবে? একসাথে হওয়া যাবে কিভাবে? একসাথে হওয়ার জন্য আমরা বলেছি আমরা অধিকারের রাজনীতি করব। অধিকার নিয়ে কাজ করলে মতভেদগুলো দূরীভূত হয়ে যাবে।
আমরা মনেকরি তত্ত্ব আর মতবাদের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে দেশে বিভেদের দেয়াল তৈরি হয়ে গেছে। দলের সাথে দলের, মতের সাথে মতের দ্বন্দ্ব ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এক মতের লোক অন্য মতের লোকদের অধিকার হরণ করছে। নির্মূল ও দেশছাড়া করার ঘোষনা দিচ্ছে।
একই আদর্শ ধারণ করে অথচ মতভিন্নতার কারণে দল গঠিত হয়েছে অসংখ্য। গণতন্ত্রে এটা সমস্যা নাই। কিন্তু এক মতাদর্শীরা যখন অন্য মতাদর্শীদের ভ্রান্ত, পথভ্রষ্ট, কাফের, ফেতনাবাজ বলে ঘোষনা দেয় তখনি তা ক্রমশ: স্বৈরতান্ত্রিকতায় রূপ নেয়। এভাবেই ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়। ফ্যাসিবাদ এমন জঘন্য যে সে বিপরীত মতাদর্শের লোকদের খতম করার পর নিজের দলের ভিন্ন মতালম্বীদের উপরও চড়াও হয়। এসব মূল্যায়ন থেকেই আমরা মতবাদ কায়েমের পরিবর্তে অধিকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি করতে চাই।
অধিকার প্রতিষ্ঠাকে যদি আদর্শ হিসেবে নেয়া হয় তাহলে ঐক্যবদ্ধতা তৈরী হয়। এবং লক্ষ্য যদি হয় একটি কল্যানমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাহলে সকল মত ও পথের লোকদের জন্য সেটা হবে রক্ষাকবচ।
এক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার দুটি বিষয়কে আমরা সুস্পষ্টভাবে সামনে রেখেছি। একটি হল ইসলামের উদার দর্শন, সাম্যের নীতি ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার কর্তব্যবোধ। আর অপরটি হল মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষনাপত্রে উল্লিখিত তিন অঙ্গীকার (সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার)। অতএব বলতে পারেন এই দুই নীতির অনুপ্রেরণায় একটি কল্যানমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই আমাদের আদর্শ।
-- #